মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :
আমাকে কেউ সাথে নিতে চায়না। সবাই আমার দিকে ভিন্নচোখে থাকায়। কক্সবাজার জেলা প্রশাসনকে যখন বলি-আমার একটু কথা আছে-তখন তাঁরা বলে তুমি যে দু’নম্বর। কক্সবাজার পুলিশ প্রশাসনকে-যখন বলি, আইনশৃঙ্খলা বিষয় নিয়ে একটু দেখা করতে এসো, তখন তাঁরা বলে তুমি যে দু’নম্বর। কক্সবাজার জেলা পরিষদকে যখন বলি, একটু সহযোগিতা করো, তখন তাঁরা বলে তুমি যে দু’নম্বর। কক্সবাজার পৌরসভা’কে যখন বলি, একটু নাগরিক সুবিধা বাড়াও, তখন তাঁরা বলে তুমি যে দু’নম্বর। এভাবে সবাই আমাকে সবমসময় দু’নম্বর বলে ঠাট্টা মশকারা করতে থাকে। আমার দুঃখ হলো-তাঁরা যদি সবাই এক নম্বর হয়, আমি এখনো কেন দু’নম্বর রয়ে গেছি। আমি চিন্তা করি, আমার কি প্রপার কোন অভিভাবক নেই? কক্সবাজারের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, জনপ্রতিনিধিগণ, দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা আমি যে এখনো দু’নম্বর রয়ে গেছি-সে বিষয়ে খোঁজখবর কার্যকরভাবে রাখেন না কেন ? দেশের প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে কক্সবাজারের কৃতিসন্তানেরা আমার অভিভাবকত্বের দায়িত্ব নিচ্ছেন না কেন? আমার ক্রন্দন, আমার অসহায়ত্ব, আমার বন্ঞ্চনা দেখার কেউ কি আদৌ নেই? আমাকে কেউ কেন মনেপ্রাণে অনুভব করছেন না। আমার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ আর কত হবে। সাগরে আমার চোখের জল ফেলতে ফেলতে সাগরের পানি পর্যন্ত আমার চোখের জলের মতো হয়ে যাচ্ছে। আমি আর কত দু’নম্বর থেকে অপমানিত হবো। আর কতো লাঞ্চিত হবো। এই কথা গুলো বার বার আক্ষেপের সাথে বলছিলেন-“কক্সবাজার জেলা জজশীপ” নামক জেলার শীর্ষ বিচারিক প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু কে শুনে কার কথা।
ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন মি. কক্সের নামে নামকরণ হওয়া পর্যটন রাজধানী কক্সবাজার মহুকুমা থেকে জেলায় রূপান্তর হয়েছে-১৯৮৪ সালের ১ মার্চ। ৩৫ বছর পেরিয়ে গেছে। যৌবন শেষে এখন মধ্য বয়স পার করছে। দেশের প্রশাসনিক আইন অনুযায়ী কোন জেলায় ৮ টি প্রশাসনিক উপজেলা হলেই সে জেলাটি ‘এ’ ক্যাটাগরির জেলাতে উন্নীত হয়ে যায়। ২০০২ সালের ২৭ এপ্রিল কক্সবাজারের বৃহত্তর চকরিয়া উপজেলার ভৌগলিক এলাকা থেকে কিছু অংশ আলাদা করে পেকুয়া নামক একটি পৃথক উপজেলা প্রতিষ্ঠা করা হয়। পেকুয়া উপজেলা প্রতিষ্ঠা হওয়ার মাধ্যমে কক্সবাজার জেলায় মোট উপজেলার সংখ্যা ৮ টিতে পরিণত হয়। এরপরই সরকারী গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে কক্সবাজারকে সরকারীভাবে ‘এ’ ক্যাটাগরির জেলা ঘোষনা করা হয়। এই গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, জেলা পরিষদ সহ কক্সবাজার জেলার সকল সরকারী-সায়াত্বশাসিত প্রশাসনিক দপ্তর ‘এ’ ক্যাটাগরিতে রূপান্তর হয়ে যায়। দপ্তর গুলোর অর্গানোগ্রামে ‘এ’ ক্যাটাগরি অনুযায়ী জনবল, প্রশাসনিক অন্যান্য দায়িত্ব, মর্যাদা, সুবিধাদি ও পরিধি বর্ধিত হয়ে যায়। কিন্তু কক্সবাজার জেলা জজশীপের অবস্থান এখনো পর্যন্ত সেই দু’নম্বর অর্থাৎ ‘বি’ ক্যাটাগরিতেই দীর্ঘ ১৬ বছর যাবৎ রয়ে গেছে। কক্সবাজার জেলায় জজশীপ, ম্যাজিস্ট্রেসী এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল সহ জেলার সবক’টি আদালতে গত মার্চ মাস পর্যন্ত প্রায় ৭৪ হাজার মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এরমধ্যে শুধু হত্যা মামলা রয়েছে-প্রায় ৯ শত। এ সংখ্যা বিশেষ করে এখানে বাস্তবায়নাধীন মেঘা প্রকল্পগুলোর জন্য ভূমি হুকুম দখল করার কারণে দেওয়ানী মামলার সংখ্যা আশংকাজনক হারে বাড়ছে। ভৌগলিক, অর্থনৈতিক ও সম্পদের দিক থেকে কক্সবাজার দেশের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ জেলা। একাধিক কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ কাজ, রেল লাইন সম্প্রসারণ কাজ, মেরিনড্রাইভ রোড নির্মাণ কাজ, কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রূপান্তরিত করার কাজ সহ প্রচুর মেঘা প্রকল্প কক্সবাজারে এখন বাস্তবায়িত হচ্ছে। এর উপর ১২ লক্ষ রোহিঙ্গা শরনার্থীর সমস্যা দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করছে। মাদক, মানবপাচার, সীমান্ত সমস্যা, বঙ্গোপসাগরে জলদস্যুতা তো হরহামেশা লেগেই আছে। এসবের গুরুত্ব, মামলার আধিক্য ও মামলার জট তুলে ধরে ২০১৮ সালের ২১ জুন ২৫৬ নম্বর স্মারকে তৎকালীন কক্সবাজারের জেলা জজ মীর শফিকুল আলম (২৬৫) বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের রেজিস্টার জেনারেলের মাধ্যমে আইন ও বিচার বিভাগের সচিবকে কক্সবাজার জেলা জজশীপকে ‘বি’ ক্যাটাগরী থেকে ‘এ’ ক্যাটাগরিতে উন্নীত করে প্রয়োজনীয় বিচারক ও জনবল নিয়োগ দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়ে পত্র দিয়েছিলেন। কিন্তু কক্সবাজার জেলা জজশীপের সেই আবেদন সুবিবেচনা করা তো দূরের কথা, পত্র’টির বিন্দু পরিমাণ অগ্রগতি হয়নি বলে অসহায় কক্সবাজার জেলা জজশীপ বেদনার্ত হৃদয়ে কান্নাজড়িত কন্ঠে তা প্রকাশ করেছে। অথচ কক্সবাজারের চেয়ে অনেক কম মামলার সংখ্যা ও দেশের অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ অনেক জেলার জজশীপ এখন ‘এ’ ক্যাটাগরির সুবিধা ভোগ করছে। কক্সবাজার জেলা জজশীপের যৌক্তিক ও ন্যায্য অভিযোগ-আমাকে কেন এখনো দু’নম্বর করে রাখা হয়েছে? আমি তো ক্রমান্বয়ে খুড়ো হয়ে যাচ্ছি, আমি আর চলতে পারছিনা। দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হয়েছে। সহসায় পরিবর্তন নাহলে আমাকে হয়ত লাইফ সাপোর্টে নিয়ে যেতে হবে। কক্সবাজারের কৃতি সন্তান, যাঁরা দেশের সর্বোচ্চ শীর্ষ পর্যায়ে প্রশাসনিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বপালন করছেন, যেমন-মন্ত্রীপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম, নির্বাচন কমিশন সচিব ও বাংলাদেশ এডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস এসোসিয়েশনের সভাপতি হেলালুদ্দীন আহমেদ সহ আরো কত মেধাবী, দায়িত্বশীল, গুনী ও বিশিষ্টজন রয়েছেন। ওনারা কেন মামলার ভারে অর্ধপঙ্গু কক্সবাজার জেলা জজশীপের করুণ ফরিয়াদে সাড়া দিচ্ছেন না। অথচ কক্সবাজার জেলা জজশীপ বিচারপ্রার্থীদের বেদনাময় আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠছে-আকাশ-বাতাস। এখানকার বিচারপ্রার্থীদের অবর্ণনীয় চরম দূর্ভোগ আর বিড়ম্বনার যেন শেষ নেই। মামলাজট ও নিস্পত্তির দীর্ঘ সূত্রিতা বিচারপ্রার্থীদের নিঃস্ব ও পঙ্গু করে ছাড়ছে। আবার সচিবালয়ে আইন ও বিচার বিভাগের নির্বাহী প্রধান চৌকষ মেধাসম্পন্ন সচিব আবু সালেহ মোহাম্মদ জহির অতি সম্প্রতি ও গত বছর পর পর দু’বার কক্সবাজার সফরেও এসেছিলেন। সেসময় বিষয়টি নিশ্চয় গতিশীল ও কর্মপাগল আইন সচিবের নজরে দেয়া আছে। এসব রথি মহারথীরা কক্সবাজার জেলার প্রায় ২০ লক্ষ মানুষের প্রয়োজনের স্বার্থে সামান্য সুনজর দিলেই কক্সবাজার জেলা জজশীপ দু’নম্বরী গ্রুপের সদস্যের অপবাদ ঘুছিয়ে এক নম্বর গ্রুপে চলে আসতে পারে। দু’নম্বর গ্রুপ থেকে এক নম্বর গ্রুপে চলে আসার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠা কক্সবাজার জেলা জজশীপের আকুতি হলো-এ প্রতিষ্ঠানটির ন্যায্য হক আদায়ের ব্যাপারে জনপ্রতিনিধি, জেলার উর্ধ্বতন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, আইনজীবীনেতারা, দায়িত্বশীল কর্মকর্তাগণ একটু গুরুত্ব সহকারে দায়িত্ব নিয়ে প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাছে বিষয়টি নিয়ে তাঁদেরকে প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি করাতে পারলেই সহজেই দু’নম্বরীর অপবাদ থেকে মুক্ত হওয়া যাবে। আর কক্সবাজার জেলা জজশীপ ‘বি’ ক্যাটাগরি থেকে ‘এ’ ক্যাটাগরিতে উন্নীত হলেই জজশীপে পর্যাপ্ত বিচারক ও অন্যান্য জনবল আপনাআপনি প্রায় ৩ গুনে উন্নীত হয়ে যাবে। কক্সবাজার জেলাবাসী অত্যন্ত প্রয়োজনীতা অনুভব করা পরিবেশ আদালত, বিদ্যুৎ আদালত, শ্রম আদালত, দুর্নীতিদমন আইনের মামলার স্পেশাল বিচারকের স্থায়ী আদালত সহ বিভিন্ন ধরণের আদালত, যেগুলো এখন কক্সবাজারে নেই, কক্সবাজার ‘এ’ ক্যাটাগরির জজশীপে রূপান্তর হলেই সেসব আদালত আপনাআপনি গিফট হিসাবে পাওয়া যাবে। তাই কক্সবাজার জেলা জজশীপকে দু’নম্বরীর অপবাদ ঘুছিয়ে এক নম্বরি জজশীপ করা এখন সময়ের অন্যতম দাবী। এই প্রাণের দাবী পূরণে সংশ্লিষ্ট সকল মহল আন্তরিকতার সাথে এগিয়ে আসবেন-এ প্রত্যাশায় থাকল।
(লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট, প্যানেল আইনজীবী, জেলা লিগ্যাল এইড কমিটি, কক্সবাজারর)।
পাঠকের মতামত: